যে কারণে রোজা ভেঙে যায় - কি কি করলে রোজা ভাঙে না

প্রিয় পাঠক, বছর ঘুরে এসেছে রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস রমজান। আমরা রোজা ভেঙে যাওয়ার কারণগুলো অনেকেই জানি আবার হয়তো অনেকেই জানি না। তাই আজকের পোষ্টে যেসব কারণে রোজা ভেঙে যায় এবং যে কারণে রোজা ভাঙে না সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
যে কারণে রোজা ভেঙে যায় - কি কি করলে রোজা ভাঙে না
রোজা সম্পর্কে ইসলামে কি কি বলা আছে, কি কি বলা নেই, এই সম্পর্কে জানতে অনেকেই গুগলে সার্চ করে থাকেন। গুগলের কাছে জানতে চাওয়া এরকম প্রচলিত প্রশ্নের উত্তর এই পোষ্টে দেওয়া হবে। প্রতিটা মুসলিমের এই সম্পর্কে জেনে নেওয়া জরুরি। তাই অবহেলা না করে এই পোস্টটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে থাকুন।
পোষ্ট সূচিপত্রঃ

উপস্থাপনা

মাহে রমজান মাসে যারা রোজা রাখে, তারা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনো কিছুই পানাহার করেন না। পবিত্র মাহে রমজান আমাদেরকে প্রতিটা মানষের সাথে সামাজিকতার অনেক কিছু শিক্ষা দেয়। আমাদেরকে মানবতার বার্তা দিয়ে থাকে।
 
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ বিশ্বাস করেন যে, মাহে রমজান মাসে স্বেচ্ছা নিয়ন্ত্রণ এবং অধিক সময় ধরে দোয়া-প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে নতুনভাবে আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে পারবেন। আসুন, আমরা প্রথমে জেনে নিব যেসব কারণে রোজা ভেঙে যায় সেই সম্পর্কে।

যেসব কারণে রোজা ভেঙে যায়

পবিত্র মাহে রমজানে প্রতিটা মুসলিম উম্মাহ সঠিকভাবে সিয়াম পালন করতে চায়। তবে আমরা হয়তো অনেকেই জানি না যেসব কারণে রোজা ভেঙে যায়। তাই যেসব কারণে রোজা ভেঙে যায় তা নিম্নে তুলে ধরা হলো-
  • ইচ্ছাকৃতভাবে বমি করলে বা মুখে বমি আসার পরে তা সামান্য পরিমাণ গিলে ফেললে রোজা ভেঙে যাবে। (মুসলিম, মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক)।
  • নাক ও কানে তেল দেওয়ার ফলেও রোজা ভেঙে যায়। কিন্তু কাফফারা ওয়াজিবখবে না (হেদায়া)।
  • ইনহেলার ব্যবহার করলে রোজা ভেঙে যায়। (শামি)
  • যদি কোনো কারণে নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে মুখে চলে আসে তাহলে রোজা ভেঙে যাবে। (তাতারখানিয়া)
  • কোনো রোজাদার মহিলার যদি ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে হায়েজ (মাসিক) ও নেফাস (প্রসবজনিত রক্তক্ষরণ) হয়ে যায় তাহলে রোজা ভেঙে যাবে।
  • রোজা রাখা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী সহবাস করলে, এই সহবাসে বীর্যপাত হোক বা না হোক উভয়েরই রোজা ভেঙে যাবে। এমতবস্থায় ৫ গুন কবিরা গুনাহ হবে; যার ফলে তাদেরকে তওবা করতে হবে। সেই দিনের রোজার কাফফারা দিতে হবে। যেমন টানা ৬০ দিন রোজা রাখা অথবা একজন গোলাম আজাদ করতে হবে কিংবা মোট ৬০ জন মিসকিনদেরকে একবেলা খাবার খাইয়ে দিতে হবে।
সাধারণত মুসলিমরা অনেক কিছুকেই রোজা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। তবে ইসলামে রোজা ভাঙ্গার মূল কারণ হচ্ছে ৫টি সেগুলো হচ্ছে-
  • ইচ্ছাকৃতভাবে খাবার খেলে
  • ইচ্ছাকৃতভাবে পানাহার করলে
  • মুখ ভর্তি বমি করলে বা হলে
  • মানবদেহ থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়লে
  • রোজা রাখা অবস্থায় সঙ্গীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে।

কি কি করলে রোজা ভেঙ্গে যায় না

কি কি করলে রোজা ভেঙ্গে যায় না বা যে কারণে রোজা ভেঙে যায় না সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো। এই বিষয়ে মাওলানা শফীকুর রহমান নদভী (রহ.) এর হানাফী মাযহাব অনুযায়ী আল ফিকহুল মুয়ান্সার গ্রন্থে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। সেই উক্ত গ্রন্থ হতে কি কি করলে রোজা ভেঙ্গে যায় না তা  সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো-
  • রোজাদার ব্যক্তি ভুলবশত কারণে খাবার খেয়ে ফেললে।
  • যদি রোজাদার ভুলবশত পানাহার করে।
  • অনিচ্ছাকৃতভাবে বমি হলে রোজা ভেঙ্গে যায় না। বমি কণ্ঠনালীতে আসার পর নিজে নিজে ভেতরে প্রবেশ করলে রোজা ভাঙবে না।  (তিরমিজি: ১/১৫৩)।
  • রোজাদার ব্যক্তির স্বেচ্ছা ব্যতিরেকে ধূলাবালি গেলে, যদি কোনো মেশিনের ধূলা হয় তবুও।
  • রোজাদার ব্যক্তির অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে গলায় মশা বা মাছি প্রবেশ করলে।
  • অনেকেই মনে করেন রক্ত পরিক্ষা করলে রোজা ভেঙে যায়, কিন্তু না ইঞ্জেকশন দ্বারা রোজা নষ্ট হয় না।
  • রোজাদার ব্যক্তি বেহুশ বা অচেতন হয়ে গেলে রোজা ভেঙে যায় না। (সুনানুল কুবরা: ৪/২৩৫)।
  • আতর, সুরমা, কাজল ইত্যাদি দ্বারা রোজার কোন ক্ষতি হয় না। (ফিকহুস সুনান: ১৩০৫)
  • রোজা রেখে মিসওয়াক করলে রোজার কোনো ক্ষতি হবে না। এমনকি ইফতারের আগে মিসওয়াক করলেও সমস্যা নেই। (বোখারি : ১/২৫৯)।
  • রোজাদার ব্যক্তির গলায় স্বেচ্ছাকর্ম ব্যতিরেকে ধোঁয়া গেলে।
  • কেউ পুকুরে বা নদীতে গোসল করার সময় কানে পানি প্রবেশ করলে।
  • রাতে সহবাস করলে কোনো অসুবিধা নেই। সহবাসের পর যদি গোসল না করে সেহরি খেয়ে ফজরের ওয়াক্ত হওয়ার পর গোসল করা হয় তাহলেও কোনো সমস্যা নেই। রাসুল (সা.) থেকে এই কাজটি সাব্যস্ত আছে। (ফিকহুস সুনান: ১৩০৪)

মুখের লালা গিলে ফেললে কি রোজা ভেঙ্গে যায়?

আমরা উপরে যে কারণে রোজা ভেঙে যায় এবং কি কি করলে রোজা ভাঙে না সেই বিষয়ে আলোচনা করেছি। আশা করছি, আপনারা জানতে পেরেছেন। এবার আমরা মুখের লালা গিলে ফেললে কি রোজা ভেঙ্গে যায় কিনা? সেই বিষয়ে জেনে নিব। এই বিষয়ে অনেকেরই বিভ্রান্তি রয়েছে। 

মুখে থুথু আসাটা একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে আমাদের মধ্যে অনেকেরই রোজা থাকা অবস্থায় অতিরিক্ত থুথু বা লালা আসে। এজন্য, বার বার থুথু ফেলতে থাকেন যার ফলে গলা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় পিপাসা লেগে যায়। এজন্য অনেকেই থুথু গিলে ফেলেন।

বিশুদ্ধ মাসআলা অনুযায়ী, কোনো রোজাদার ব্যক্তি যদি থুথু গিলে ফেলে, তাহলে এতে তার রোজা নষ্ট বা ভেঙে যায় না। এমনকি থুথুর পরিমাণ খুব বেশি হলেও রোজা ভেঙ্গে যাবে না। তবে নিজের থুথু নিজের মুখ থেকে বের করে আবার তা গিলে ফেললে রোজা ভেঙ্গে যাবে। (আমলগীরী, প্রথম খণ্ড, ২০৩ পৃষ্ঠা)। আশা করছি, বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন।

ইচ্ছাকৃতভাবে কফ গিলে ফেলা কি জায়েজ আছে?

পবিত্র মাহে রমজান মাসে অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে কফ গিলে ফেলে। এজন্য তারা জানতে যায় যে, ইচ্ছাকৃতভাবে কফ গিলে ফেলা কি জায়েজ? এই প্রশ্নের উত্তর কফ হচ্ছে একপ্রকার ঘৃণিত জিনিস। তাই রোজাদার ও বে-রোজাদার উভয়ের জন্যে কফ গিলে ফেলা জায়েজ নয়।

তবে কফ গিলে ফেললে রোজার নষ্ট বা ভেঙে যায় না। কারণ, কফ মুখ থেকে বের হয় না। কফ গিলে ফেলাতা পানাহার হিসেবে বিবেচিত হয় না। সুতরাং, রোজা রাখা অবস্থায় মুখে কফ চলে আসার পর গিলে ফেললে রোজা ভাঙবে না। (আল-শারহুল মুমতি; শাইখ উছাইমিন: ৬/৪২৮)

রোজা রেখে রান্নার সময় খাবারের স্বাদ গ্রহণ করা যাবে?

রোজা রেখে অনেকসময় যিনি রান্না করেন, রান্নার স্বাদ বোঝার প্রয়োজন পড়ে। তাই প্রায় প্রত্যেকের ঘরের মা-বোনদেরকে রান্নার সময় খাবার কিছুটা চেখে বা ঝাল লবন ঠিক আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হয়। তবে এরকম কথা অনেকেই বলেন যে, রোজা রেখে খাবারের স্বাদ নিলে নাকি রোজা  মাকরূহ হয়ে যায়।

এই বিষয়ে অধ্যাপক আলম সাহেব বিবিসি নিঞ্জের প্রতিবেদনে কি বলেছেন চলুন আমরা জেনে নেই। প্রসঙ্গে অধ্যাপক আলম সাহেব বলেন, রোজা রাখা অবস্থায় খাবারের স্বাদ নেয়া যাবে। রমজান মাসে ইফতার অনেকেই বাসায় বানিয়ে থাকেন।

তাই রমজান মাসে রান্নাবান্না থেকে তো আর দূরে থাকা যাবে না। খাবারের স্বাদ বোঝার জন্য খাবার জিহ্বায় দিলেই বোঝা যায়। তাই খাবারের লবন বা ঝাল বোঝার জন্য জিহ্বায় লাগিয়ে আবার ফেলে দিতে হবে। তবে তিনি আরো বলেন, ঘরে যারা কম বয়সী অথবা রোজা রাখেনি তাদেরকে দিয়ে খাবারের ঝাল-লবন টেষ্ট করালে বেশি ভালো হয়।

রোজা রেখে সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে?

রোজা রেখে সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে কিনা এই বিষয়ে অনেকেই বিভ্রান্তির মধ্যে থাকেন। আবার অনেকে বলেন রোজা রেখে সুগন্ধি ব্যবহার করা যাবে না। এই বিষয়ে অধ্যাপক শামছুল আলম ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন। তবে সুগন্ধি বলতে আতর ব্যবহার করা যাবে, এটা আমাদের নবীর সুন্নত।

আতর ব্যবহারে কোনো নিষেধ নেই। যুগ যুগ ধরে নবী রাসূলরা আতর ব্যবহার করে গেছেন। তবে পারফিউম ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ সর্তকতা রয়েছে। কারণ পারফিউম তৈরিতে অ্যালকোহল ব্যবহার করা হয়। আর অ্যালকোহল নামে হারাম হিসেবে ঘোষণা রয়েছে।

তাই পারফিউম ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে, শুধু আতর ব্যবহার করা সবচেয়ে উত্তম। কিন্তু, বর্তমানে পৃথিবীতে সবকিছু হালাল উৎপাদন হয়। তাই আপনি পারফিউম ব্যবহার করতে চাইলে  কেনার সময় অ্যালকোহল ফ্রি কিনা সেটা দেখে ব্যবহার করা উচিত। আশা করছি, বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন।

লেখকের শেষকথাঃ যে কারণে রোজা ভেঙে যায় | কি কি করলে রোজা ভাঙে না

আমরা ইতিমধ্যে যে কারণে রোজা ভেঙে যায় এবং কি কি করলে রোজা ভাঙে না এই সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করেছি। আশা করছি, আপনারা জেনে উপকৃত হবেন। আপনি যদি সম্পূর্ণ পোষ্টে কোন বিষয়ে বুঝতে না পারেন, তাহলে অবশ্যই কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। তাহলে, যথাযথভাবে সঠিক তথ্য দিয়ে আপনাকে সাহায্য করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।

যে কারণে রোজা ভেঙে যায় এবং কি কি করলে রোজা ভাঙে না আমাদের আজকের এই পোষ্টটি শেয়ার করতে ভুলবেন না। এতে অন্যরাও এই সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবেন। তথ্যবহুল নিত্য নতুন স্বাস্থ্য এবং ইসলামিক তথ্য সম্পর্কিত অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট পড়তে আমাদের ওয়েবসাইটের সাথেই থাকুন। ধন্যবাদ

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আমাদের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url